ডেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলা: বিচার, বিতর্ক ও একটি জাতির ক্ষত
লেখক: অভিজিৎ বোস
সাঈদীর মৃত্যুতে যুদ্ধাপরাধ বিচারের অধ্যায়ের সমাপ্তি, কিন্তু বিতর্কের ছায়া দীর্ঘ
হত্যা ও ধর্ষণ: পারেরহাটে ৫০+ বেসামরিক নাগরিক হত্যা এবং গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তিন নারীকে তুলে এনে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষণের জন্য সরবরাহ ।
-ধর্মীয় নিপীড়ন: হিন্দু সম্প্রদায়ের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও সম্পদ লুণ্ঠন ।
বিচারটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ," — সাঈদীর আইনজীবী, ২০১৩
বিস্তারিত পড়ুন 👇👇
ঢাকা, ১১ জুন ২০২৫** — বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত যুদ্ধাপরাধ মামলার কেন্দ্রে থাকা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ৮৩ বছর বয়সে কারাগারে মারা গেছেন। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্মীয় নিপীড়নের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই নেতার মামলা জাতিকে বিভক্ত রেখে গেছে ।
সাঈদী কে ছিলেন?
প্রারম্ভিক জীবন: ১৯৪০ সালে পিরোজপুরে জন্ম। খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা। দেশজুড়ে ওয়াজ মাহফিলে তার বক্তৃতা লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটাত ।
রাজনৈতিক জীবন: ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পিরোজপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত। ২০০৯ সালে জামায়াতের নায়েবে আমীর হন ।
---
২০১৩ সালের ঐতিহাসিক রায়: যুদ্ধাপরাধের দণ্ড
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৮টিতে দোষী সাব্যস্ত করে। এর মধ্যে ছিল:
রায়ের প্রেক্ষাপটে সহিংসতা ও জাতীয় বিভক্তি
-সমর্থকদের বিক্ষোভ: রায়ের দিনই দেশব্যাপী সংঘর্ষে নিহত হন কমপক্ষে ৩০ জন, আহত ৩০০+ ।
-ধর্মঘটের ডাক: জামায়াতে ইসলামী রায় প্রত্যাখ্যান করে দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকে ।
- আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:মানবাধিকার সংস্থাগুলো ট্রাইব্যুনালের পদ্ধতিতে "আন্তর্জাতিক মানের ঘাটতি" রেখেছে বলে সমালোচনা করে ।
হত্যা ও ধর্ষণ: পারেরহাটে ৫০+ বেসামরিক নাগরিক হত্যা এবং গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তিন নারীকে তুলে এনে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষণের জন্য সরবরাহ ।
-ধর্মীয় নিপীড়ন: হিন্দু সম্প্রদায়ের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও সম্পদ লুণ্ঠন ।
বিচারটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ," — সাঈদীর আইনজীবী, ২০১৩
---
২০১৪: সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড রদ
সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এই সিদ্ধান্তে:
-ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ক্ষোভ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কাঁদানে গ্যাস ও ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার ।
জামায়াতের অসন্তোষ: দলটি রায়কে "মিথ্যা ও ফেব্রিকেটেড" বলে আখ্যায়িত করে ।
---
বিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়ার অভিযোগ
-সাক্ষী অপহরণ: ২০১২ সালে প্রতিবাদী সাক্ষী সুখরঞ্জন বলিকে ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে অপহরণের অভিযোগ ।
-আইনজীবী বয়কট: সাঈদীর আইনজীবীরা "পক্ষপাতদুষ্ট প্রক্রিয়া" বলে বিচার বর্জন করেন ।
-নিরপেক্ষতা প্রশ্ন:দ্য ইকোনমিস্ট* ট্রাইব্যুনালকে "সরকারি হস্তক্ষেপে দূষিত" বলে উল্লেখ করে ।
---
মৃত্যু ও উত্তাল রাজনীতির অবসান
-চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু: ১৪ আগস্ট ২০২৩ সালে শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ।
-অন্তিম সময়েও বিতর্ক: মৃত্যুর পরও ক্ষমতাসীন আ. লীগ ও জামায়াতের মধ্যে বাকবিতণ্ডা অব্যাহত থাকে ।
---
জাতীয় স্মৃতি ও ন্যায়বিচারের অনন্ত সংগ্রাম
সাঈদীর মামলা কেবল একটি বিচারিক প্রক্রিয়া নয়, বরং বাংলাদেশের যুদ্ধস্মৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের লড়াইয়ের প্রতীক:
২০১৩-এর রক্তাক্ত অধ্যায়:শাপলা চত্ত্বর ও মোটিজহিলে নিরস্ত্র ইসলামপন্থীদের ওপর পুলিশি হামলায় ৬১ জন নিহত ।
-ইউএনের ডকুমেন্টেশন উদ্যোগ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনুসের অনুরোধে ২০১৩-এর সহিংসতা ডকুমেন্ট করতে জাতিসংঘের প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রতিশ্রুতি ।
ইউএন প্রতিক্রিয়া:"এই ডকুমেন্টেশন সত্য প্রতিষ্ঠা ও নিরাময়ের প্রক্রিয়া,"* — জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কোঅর্ডিনেটর গ্যুইন লুইস
---
**অমীমাংসিত প্রশ্ন: একটি জাতির ভবিষ্যৎ**
> *"৪ দশক পরেও আমরা জানি না – সাঈদী কি ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক, নাকি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার?"* — ইতিহাসবিদ ড. মেহেদী হাসান
সাঈদীর মৃত্যু বিচারের আইনি অধ্যায় শেষ করলেও তা রেখে গেছে গভীর বিভক্তি। ট্রাইব্যুনালের সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন:
ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার: ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের দাবি কি আদৌ পূরণ হয়েছে?
- **রাজনীতিকরণের অভিযোগ:** ক্ষমতার পালাবদলে এই মামলার রায় কি আবার উল্টে যাবে?
জাতীয় নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন সঠিক ডকুমেন্টেশন, স্বচ্ছ তদন্ত এবং সকল পক্ষের স্বীকৃতি – যা এখনো বাংলাদেশের জন্য এক অসম্পূর্ণ অধ্যায় ।


0 মন্তব্যসমূহ